রিট পিটিশনের আশু কার্যকারিতা চান বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো
রিট পিটিশনের আশু কার্যকারিতা চান বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো । প্রশিক্ষক সংকট, স্থাপনা না থাকা ও সর্বোপরি নাম সর্বস্ব হওয়ায় ৩৭ টিচার্স ট্রেনিং কলেজকে (টিটিসি) লাল তালিকাভুক্ত করেছিল সরকার। কিন্তু কৌশল ও অপতৎপরতায় সেসব কলেজ এখন বৈধতার দাবি করে। এদিকে যেসব বেসরকারি কলেজের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিলোনা, তাদেরকেই এখন অবৈধ কলেজ বলা হচ্ছে।
মুক্ত প্রভাত এর অনুসন্ধানে দেশের বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের (টিটিসি) এমন অবস্থা দেখা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও বৈধ কলেজগুলো রাজশাহী অঞ্চলের কিছু কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) সনদধারী শিক্ষকদের এমপিও স্কেল দিচ্ছে না সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এ ব্যাপারে অনেক দেন দরবার করেও সুরাহা হয়নি। এক সময়ের লাল তালিকাভুক্ত কলেজগুলোর সনদ ছাড়া বিএড স্কেল দেয়া হচ্ছে না। এতে সংশ্লিষ্ট বৈধ কলেজগুলো থেকে বিএড সনদ নেয়া শিক্ষকরা বড় আর্থিক ক্ষতি ও ভোগান্তিতে পড়েছেন।
জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় চাকরিতে যোগাদানে বিএড প্রশিক্ষণ দরকার। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় চাকরিতে যোগদানের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড প্রশিক্ষণ নেয়া বাধ্যতামূক। শিক্ষকদের মানোন্নয়নে বিএড ডিগ্রির সনদ থাকা জরুরি। তবে এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের দেড় লাখের বেশি শিক্ষকের এই ডিগ্রি নেই।
বাংলাদেশে বিএড প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি কলেজ রয়েছে ১৪টি ও ১টি বিএমটিটিআই।বেসরকারি কলেজের সংখ্যা ১০৭টি। বর্তমানে কার্যক্রম চালাচ্ছে ৭১টি। এসব কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘটনার শুরু হয় ২০০৮ সালে। নানা অনিয়মের কারণে সে সময় বিএড সনদদাতা ৩৭টি বেসরকারি কলেজকে লাল তালিকাভুক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বলা হয়, এসব কলেজ থেকে বিএড সনদের বিপরীতে স্কেল দেয়া হবে না। একই সঙ্গে বেসরকারি কোনো বিএড কলেজ থেকে প্রাপ্ত সনদের বিপরীতে স্কেল দেয়া হবে না বলে পরবর্তী আরেক সিদ্ধান্তে জানানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে এসব কলেজের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে তারা কার্যক্রম চালিয়ে যায়। তবে জটিলতা দেখা দেয়, মাউশি এসব কলেজ থেকে সনদধারীদের বিএড স্কেল প্রদান না করায়।
এক বছর পর সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে লাল তালিকাভুক্ত ২৩টি কলেজ। মামলার বাদী হন সাতক্ষীরার হাজী ওয়াজেদ আলী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ।
মাউশির আইন শাখার কর্মকর্তা আল আমিন সরকার মুক্ত প্রভাত কে জানান, ২০১৩ সালে আদালত এক রায়ে ওইসব কলেজ থেকে যেসব শিক্ষক ইতোমধ্যে (২০০৮-২০১৩) সনদ নিয়েছেন তাদের বিএড স্কেল প্রদানের আদেশ দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে বিএড স্কেল প্রদান আটকে যায়।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে আদালত আপিলের শুনানিতে ২০০৮-২০১৬ সাল পর্যন্ত যেসব শিক্ষক লাল তালিকাভুক্ত কলেজগুলো থেকে বিএড সনদ নিয়েছেন তাদের স্কেল দেয়ার আদেশ দেন। তবে কলেজগুলো তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে কিনা- বা চালালেও ভবিষ্যতে তাদের সনদ গ্রহণ করা হবে কিনা এ বিষয়ে আদেশে কিছুই বলা হয়নি। তবে কোনো বেসরকারি টিটিসির সনদের বিপরীতে বিএড স্কেল প্রদান না করার যে সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়েছিল সেটি মন্ত্রণালয়ের ওপর ছেড়ে দেন আদালত।
এমন পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালে মাউশির আইন কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব) ড. ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে লাল তালিকার ২৩ কলেজ থেকে সনদধারীদের বিএড স্কেল দেয়া হবে বলে জানানো হয়। এক চিঠিতে ব্যবসায় বিপত্তি। মাউশির কর্মকর্তারা জানান, লাল তালিকার কলেজে কোন ক্লাস হয় না, নেই কোন অবকাঠামো। সেক্ষেত্রে কোন রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষকরা সার্টিফিকেট অর্জন করেন। যার ফলে শিক্ষাদানে এই কোর্সের কোন প্রভাব থাকে না।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-২) দুর্গা রাণী সিকদার স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়, আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে ২৩টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের (লাল তালিকাভুক্ত) বাইরেও অন্য টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে অর্জিত সনদের বিপরীতে বিএড স্কেল প্রদান করা হচ্ছে। এতে সরকারের বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই অবস্থায় ২৩ কলেজের বাইরে অন্য কলেজগুলোর সনদ গ্রহণ না করতে মাউশির সকল আঞ্চলিক উপ-পরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশ দেয়া হয়।
পরে বৈধ কলেজগুলোর প্রতিনিধিরা এর প্রতিবাদ জানালে কয়েকদিনের মাথায় ওই নির্দেশ বাতিল করা হয়। তবে বাতিলের চিঠির স্মারক নম্বর উল্লেখ করে বাতিল ছাড়া বিস্তারিত কিছু না বলায় বৈধ কলেজগুলোর সমস্যা থেকেই যায়। এমনকি বাতিল করা চিঠি মাউশি অজ্ঞাত কারণে সংশ্লিষ্ট দফতর কিংবা নিজস্ব ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করে নি।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০০৮ সালে লাল তালিকার ২৩ কলেজ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করে শুধু তারাই বৈধ অন্যরা অবৈধ। তাদের কলেজ ছাড়া অন্য কোথাও ভর্তি না হতে বিজ্ঞাপনে জানানো হয়। এতে বিভ্রান্তি দেখা দেয় শিক্ষকদের মনে। এমনকি চিঠি বাতিল করার পরও মাউশি গত দুই বছরে বৈধ কলেজগুলো থেকে সনদধারীদের বিএড স্কেল প্রদানে গড়িমসি করে।
ফলে বাকি কলেজগুলোর পক্ষে উচ্চ আদালতে আরেকটি রিট করেন ঢাকার ধানমন্ডিতে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কলেজ এর অধ্যক্ষ ও বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মুহাম্মাদ নজরুল ইসলাম খান। তিনি মুক্ত প্রভাত কে বলেন, “আমরা এ বিষয়টি সুরাহা চেয়ে মাউশি ডিজি মহোদয়ের কাছে বারবার ধর্না দিয়েছি। তিনি আমাদেরকে মৌখিকভাবে নানা আশ্বাস দিলেও কার্যত আমাদের সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই আমরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি।”
এ বিষয়ে মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক) দূর্গা রানী মতামত জানতে চাইলে তিনি এ বিষয় কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি এ বিষয় মাধ্যমিক শাখার পরিচালক প্রফেসর বেলাল হোসাইন এর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে বেলাল হোসাইন বলেন, দূর্গা রানী সিকদার যা বলেছেন এর বাইরে আমার কিছু বলার নাই।
এদিকে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এর শিক্ষকগণ রিটের দ্রুতই সমাধান চাচ্ছেন। বিষয়টি বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।